‘আইনকানুন সর্বনেশে’ চীন ফুটবলে

অন্য অনেক দেশের ফুটবলে হয়তো এ ধরনের কাজকে হয়তো অপরাধ হিসেবেই ধরা হবে না। কিংবা কিছু ক্ষেত্রে অপরাধ হলেও সেটাকে মৃদু ভর্ৎসনা বা মৌখিক সতর্কবাণীতেই শেষ। কিন্তু চীনের ফুটবলে ঠিক ওই রকম কাজগুলোই বিশাল অপরাধ, যার জন্য খেলোয়াড় কিংবা কোচদের গুনতে হবে বিশাল অঙ্কের জরিমানা অথবা পেতে হবে নিষেধাজ্ঞা।
উদাহরণ শুনবেন? মাঠে কখনো রেগে গিয়ে পানির বোতলে লাথি মারলে ১৫ হাজার ইউয়ান (প্রায় ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা) জরিমানা। রেফারির সমালোচনা করেছেন তো পকেট থেকে খসে যাবে ২০ হাজার ইউয়ান। চীনের হয়ে খেলার সময় কোনো গয়না পরেছেন, তাহলে তো কথাই নেই। এক বছরের নিষেধাজ্ঞা জাতীয় দল থেকে! খেলোয়াড়দের শরীরে কোনো উল্কি দৃশ্যমান থাকলেও পেতে হবে নিষেধাজ্ঞা।
শুনতে অদ্ভুত লাগছে? লাগারই কথা। চায়নিজ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (সিএফএ) এসব অদ্ভুত নিয়মকানুন নিয়ে দেশটির ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যেও চলছে হাসাহাসি। নতুন নতুন কী কী অপরাধ এই তালিকায় যোগ হতে পারে, কী রকম শাস্তি হতে পারে, এ নিয়ে অনলাইনে সমর্থকদের মধ্যে চলছে ব্যঙ্গ-রসিকতা।
এমনিতে বছর পাঁচ-ছয়েক আগেও চীনের ফুটবল নিয়ে ইউরোপ কিংবা ফুটবলপ্রেমী অন্য দেশগুলোর খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তবে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে দলবদলের বাজারে চায়নিজ ক্লাবগুলোর বিশাল ব্যয়, বিশাল বেতনে খেলোয়াড় কেনা নজর কাড়ে সবার। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংও কিছুদিন আগে ঘোষণা দিয়েছেন, চীনকে বিশ্ব ফুটবলের সেরা হিসেবে দেখতে চান তিনি।
ক্লাবগুলো বাড়াবাড়ি রকমের টাকা ওড়াতে শুরু করায় গত বছর সিএফএ দলবদলের বাজারে খরচের একটা সীমারেখা বেঁধে দিয়েছে। তারপর এসব অদ্ভুত নিয়মকানুন। সব মিলিয়ে চীনের ফুটবলে একধরনের জগাখিচুড়ি অবস্থাই চলছে। দেশটির ফুটবল বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট জি জাই যেমন মনে করছেন, এ ধরনের শাস্তিতেই প্রমাণিত হয়, চীনের ফুটবল কর্তৃপক্ষ নিয়মকানুনের ব্যাপারে যথেষ্ট ধারাবাহিক ও স্বচ্ছ নয়।
চীনের একটি বিখ্যাত ক্রীড়া বিপণন সংস্থার প্রধান জাইয়ের মতে, ছোটখাটো অপরাধেই কঠোর এ ধরনের শাস্তি দিয়ে হয়তো বড় অপরাধ আটকাতে চায় সিএফএ ও চায়নিজ সুপার লিগ (সিএসএল) কর্তৃপক্ষ। অনেকটা চীনে প্রচলিত সেই প্রবাদের মতো, বিড়ালকে মেরে বানরকে ভয় দেখানো।
নিয়মকানুনের কড়াকড়ি শুধু চীনের ফুটবলেই নয়, দেশটির সব ক্ষেত্রেই। তবে ফুটবলের এসব নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন চায়নিজ লিগে খেলতে আসা বিদেশি খেলোয়াড় ও কোচেরা।
ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার অস্কারের কথাই ধরুন। ৬ কোটি ৭৯ লাখ ডলার ট্রান্সফার ফিতে গত বছর যোগ দিয়েছেন সাংহাই এসআইপিজিতে। এশিয়ান ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় তিনি। গত মৌসুমেই প্রতিপক্ষ এক খেলোয়াড়ের গায়ে বল লাথি মাথার কারণে ৮ ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তাঁকে। একই ক্লাবে তাঁর ব্রাজিলিয়ান সতীর্থ হাল্ক একবার নিজের দেশের সমর্থনে ব্রাজিলের টি-শার্ট পরে এসেছিলেন মাঠে। তাঁর জুটেছে দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা!
অস্কারের ঘটনাটার প্রতিবাদে সাংহাই এসআইপিজির তখনকার কোচ আন্দ্রে ভিয়াস-বোয়াস ইনস্টাগ্রামে লিখেছিলেন, ক্যারিয়ারে ৩৫৫টা ম্যাচ, প্রিমিয়ার লিগে ৫ বছর, ব্রাজিলের হয়ে ৪৭ ম্যাচ, পুরো ক্যারিয়ারে ৭০টা গোল। একটাও লাল কার্ড নেই। অথচ এখানে এসেই সে (অস্কার) ৮ ম্যাচ নিষিদ্ধ। ভিয়াস-বোয়াসের এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল, জানেন? দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা জোটে তাঁর কপালে!
চেলসি ও টটেনহামের কোচ থাকার সময় ভিয়াস-বোয়াসকে নিপাট ভদ্রলোক হিসেবেই চিনত সবাই। অথচ পর্তুগিজ এই কোচকে পরে আরও ৮ ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা ভোগ করতে হয়েছে একবার রেফারির সমালোচনা করায়। এক মৌসুম চীনে কাটিয়েই ভিয়াস-বোয়াস পাততাড়ি গোটানোয় কেউই অবাক হননি।
এখানেই শেষ নয়; গত সপ্তাহে সিএফএর শৃঙ্খলা কমিটি চেংচুয়ান ইয়াতাই ক্লাবের মিডফিল্ডার জ্যাং লিকে ছয় ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে খেলায় বিঘ্ন ঘটানো ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি করার অপরাধে। লির বিরুদ্ধে আসল অভিযোগটা ছিল, তিনি সাংহাই সিনহুয়ার সেনেগালিজ স্ট্রাইকার ডেম্বা বার সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ করেছেন। কিন্তু শৃঙ্খলা কমিটির শাস্তিতে ওই অপরাধের কোনো উল্লেখই নেই। প্রশ্ন উঠেছে, যদি তিনি বর্ণবাদী আচরণ না করে থাকেন, তাহলে এত কঠোর শাস্তি কেন? আর যদি করে থাকেন, সেটা লুকিয়ে রাখা কেন?